॥ মেহেদী হাসান ॥
ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানে গত ৫ আগস্ট পতন হয় স্বৈরাচার আওয়ামী লীগ সরকারের। এরপর থেকেই গত ১৫ বছরে বিভিন্ন সময়ে সাজানো নির্বাচনে ভোট কেন্দ্র দখল, বোমা বিস্ফোরণ, বিএনপির দলীয় কার্যালয় ভাঙচুর, নেতাকর্মীদের মারধর, হত্যা চেষ্টা ও হত্যাসহ একাধিক মামলা হয়েছে বরিশাল আওয়ামী লীগের বিভিন্ন স্তরের নেতাকর্মীদের নামে। এসকল মামলায় নামধারী ও অজ্ঞাত আসামীর সংখ্যাও কয়েক হাজার। তবে এ মামলা গুলোর নথি বিশ্লেষনে কোথাও পাওয়া যায়নি বরিশাল মহানগর আওয়ামী যুবলীগের যুগ্ম আহবায়ক মাহমুদুল হক খান মামুন এর নাম।
অভিযোগ উঠেছে মহানগর বিএনপির শীর্ষ নেতাদের সাথে বিপুল অংঙ্কের অর্থের বিনিময়ে এই মামলাগুলো থেকে রেহাই পেয়েছেন তিনি। বিশ্বত্ব একাধিক সূত্র নিশ্চিত করেছেন, বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলন দমাতে সাবেক পানি সম্পদ প্রতিমন্ত্রী জাহিদ ফারুক ও সাবেক সিটি মেয়র খোকন সেরনিয়াবাত এর নির্দেশে গত ২ আগস্ট গভীর রাতে খান মামুন তার বাসভবনে গোপন বৈঠক করেন সাবেক ছাত্রলীগের নেতাকর্মীদের নিয়ে।
ওই বৈঠকে সাধারণ শিক্ষার্থী ও বিএনপি নেতাকর্মীদের ওপর হামলা চালাতে দেশীয় অস্ত্রের যোগানও দেয়া হবে বলে খান মামুন উপস্থিত ছাত্রলীগের ওই নেতাকর্মীদের নিশ্চয়তা দেন। যা এ প্রতিবেদককে নিশ্চিত করেন বৈঠকে উপস্থিত এক সাবেক ছাত্রলীগ নেতা। এমনকি ওই বৈঠকে সিদ্ধান্ত দেয়া হয় বরিশাল বিএনপি অফিসে ভাংচুর চালানোর।স্থানীয় সূত্রে জানা যায়, গত ৫ আগস্টের পরে নগরের ১৯ নং ওয়ার্ডস্থ খান মামুনের গফুর সড়কের বাসভবনে মহানগর বিএনপির এক শীর্ষ নেতার নেতৃত্বে ১০/১২ জনের একটি দল ইট পাটকেল নিক্ষেপ করে, এবং পরবর্তীতে তাদের মাঝে মোটা অংকের অর্থের লেনদেন হয়।
১৯ নং ওয়ার্ড বিএনপির একাধিক নেতা অভিযোগ করে বলেন, নগর বিএনপির শীর্ষ নেতার ওই হামলার উদ্দেশ্যই ছিলো খান মামুনকে ভয় দেখিয়ে অর্থ আদায়ের। ওই অর্থের বিনিময়ে শর্ত ছিলো বাসভবনে হামলা ও মামলা থেকে তাকে রেহাই দেয়ার নিশ্চয়তা।অপরদিকে নগর বিএনপির এক শীর্ষ নেতার মধ্যস্থতাকারীর ফাঁস হওয়া অডিও রেকর্ডে শোনা যায়, ওই মধ্যস্থতারাকী বলেন, ‘খান মামুন দেয়া নেয়ার বিষয়ে ভালো বুঝে’। যে অডিও ক্লিপটি এ প্রতিবেদকের কাছে সংরক্ষিত রয়েছে। ওই মধ্যস্থতাকারীকে গতকালও আদালত প্রাঙ্গণে নগর বিএনপির শীর্ষ নেতাদের মাঝে দেখা যায়।
জানা যায়, এক সময়ে ছাত্রলীগ নেতা হিসেবে পরিচিত মাহামুদুল হক খান মামুন বরিশাল মহানগর আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে সক্রিয় থাকলেও, ক্ষমতার দীর্ঘ সময়ে কখনো মেয়র, কখনো বা উপজেলা চেয়ারম্যান হওয়ার আশা ব্যক্ত করলেও দল তাকে কখনও মনোনয়ন দেয়নি। এমনকি দলের নির্দেশনা ভঙ্গ করে তিনি আওয়ামী লীগের বিদ্রোহী প্রার্থী হিসেবে বরিশাল সিটি করপোরেশনের মেয়র পদে নির্বাচনও করেছিলেন। ফলশ্রুতিতে নির্বাচনে হেরে আওয়ামী লীগ থেকে হয়েছিলেন বহিস্কার।
বহিস্কারে্র আদেশ নিয়ে দীর্ঘদিন ধরে খান মামুন কোনঠাসা ছিলেন বরিশাল আওয়ামীলীগ রাজনীতিতে কিন্তু পুরোটা সময় মারমুখী ছিলেন বিএনপি নেতাকর্মীদের প্রতি।আর একেক সময় একেক নেতার আর্শিবাদপুষ্ট খান মামুন অবশেষে বরিশাল সদর আসনের সাবেক সংসদ সদস্য ও সাবেক পানিসম্পদ প্রতিমন্ত্রী জাহিদ ফারুক’র ঘনিষ্টজন হতে সক্ষম হন ২০১৮ সালের সংসদ নির্বাচনের পর।বিশ্বত্ব সূত্রে জানা যায়, সাবেক পানিসম্পদ প্রতিমন্ত্রী জাহিদ ফারুক এর আশীর্বাদতুষ্ট হয়ে এই খান মামুন আওয়ামী সরকারের আমলে টিআর, কাবিখা ও বিভিন্ন প্রকল্পের কাজ বণ্টনের দায়িত্ব নিয়ে আর্থিক আখের গুছিয়ে নেয়।
বিশেষ করে পানি উন্নয়ন বোর্ডের হাজার কোটি টাকার ঠিকাদারী কাজ নিজের নামে নিয়ে বিতর্ক এড়াতে তা বিক্রি করে দিয়ে টাকা আয়ের গোপন পথে হাটতে শুরু করেন। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক বরিশাল মহানগর আওয়ামী লীগের এক সদস্য বলেন, ক্ষমতাকালীন সময়ে খান মামুন জনপ্রতিনিধির কোন আসনে না থাকলেও পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়ে তার অদৃশ্য ক্ষমতার মাধ্যমে কামিয়েছেন কয়েক শত কোটি টাকা। এমনকি খান মামুন তার ব্যাক্তিগত গাড়ি চালকের বেতনও পরিশোধ করতেন পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে। অপরদিকে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ওয়ার্ড বিএনপির এক নেতা বলেন, আওয়ামী লীগের এই দোসররা, বিএনপি নেতাদের সাথে অর্থ লেনদেন এর মাধ্যমে মামলা থেকে তাদের নামে সড়িয়ে, ব্যাক্তিগত শত্রুতার কারণে বিএনপির তৃণমূল পর্যায়ের কর্মীদের নামে মামলা দিয়েও হয়রানী করাচ্ছেন। প্রমাণ দিতে গিয়ে ওই বিএনপি নেতা আরো বলেন, জিয়া মঞ্চ বরিশাল মহানগরের যুগ্ম আহবায়ক সুজনকে বিএনপির শান্তি মিছিলে হামলার অভিযোগের দায়ের করা মামলার ৪০৭ নং আসামী করা হয়। যার বাদী নগর বিএনপির সদস্য সচিব জিয়া উদ্দিন সিকদার এবং ১ নং স্বাক্ষী নগর বিএনপির আহবায়ক মনিরুজ্জামান খান ফারুক।
জানা যায়, বিভিন্ন সময়ে খান মামুন’র মেয়র বা উপজেলা চেয়ারম্যান হওয়ার ইচ্ছে থাকলেও কখনও আওয়ামী লীগের মনোনয়ন পাননি তিনি। তবে ২০১৩ সালে জুন মাসে অনুষ্ঠিত বরিশাল সিটি করপোরেশন নির্বাচনে তিনি আওমালীগের বিদ্রোহী প্রার্থী হিসেবে মেয়র পদে নির্বাচন করেছিলেন। সে নির্বাচনে বিজয়ী হয়েছিলেন ১৮ দলীয় জোটের প্রার্থী মো. আহসান হাবিব কামাল। সবশেষ ২০২৪ সালে অনুষ্ঠিত উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে চেয়ারম্যান প্রার্থী হন এই খান মামুুন। ওই নির্বাচনে প্রতিপক্ষকে মাঠ থেকে হঠাতে সর্বোচ্চ ক্ষমতা প্রয়োগের মাধ্যমে তাদের কর্মী সমর্থকদের ওপর চালান হামলা ও দায়ের করান মিথ্যা মামলা। কিন্তু ওই নির্বাচনেও তিনি আশারুপ ভোট না পেয়ে হেরে যান।
তবে বিক্ষুব্ধ ছাত্র-জনতার আন্দোলনে গত ৫ আগস্ট পতন হয় স্বৈরাচার শেখ হাসিনা সরকারের। এরপর বরিশালে বিএনপির দলীয় কার্যালয়ের হামলা, ভাঙচুর-লুটের মামলাসহ একাধিক মামলায় আসামী হন সাবেক প্রতিমন্ত্রী জাহিদ ফারুক, সাবেক সিটি মেয়র খোকন সেরনিয়াবাত, নগর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক সেরনিয়াবাত সাদিক আবদুল্লাহসহ কয়েক হাজার নেতাকর্মী। যে মামলায় বর্তমানে বরিশাল কারাগারে রয়েছেন সাবেক পানি সম্পদ প্রতিমন্ত্রী কর্নেল (অব.) জাহিদ ফারুকসহ একাধিক আওয়ামী লীগ নেতাকর্মী ও কাউন্সিলরবৃন্দ। কিন্তু কোন মামলায় নেই নগর যুবলীগের যুগ্ম আহবায়ক মাহমুদুল হক খান মামুন।
এবিষয়ে প্রশ্ন করা হলে বরিশাল মহানগর বিএনপির আহবায়ক মনিরুজ্জামান খান ফারুক ও সদস্য সচিব জিয়া উদ্দিন সিকদার বলেন, মামলায় তাদের দেখতে পাননি, দেখতে পাবেন ইনশাআল্লাহ। অপরদিকে মুঠোফোনসহ একাধিক মাধ্যমে গত (৯ অক্টোবর থেকে ১৪ অক্টোবর) পর্যন্ত খান মামুন এর সাথে যোগাযোগের চেষ্টা করা হলেও তার কোন বক্তব্য পাওয়া যায়নি। তবে ১৩ অক্টোবর রাতে মুঠোফোনে কল রিসিভ করলেও সাংবাদিক পরিচয় পেয়ে তিনি ফোনের সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে দেন।
এদিকে, খান মামুনের বিরুদ্ধে (১৫ই অক্টোবর) বরিশালের আঞ্চলিক দৈনিক বিপ্লবী বাংলাদেশ পত্রিকায় সংবাদ প্রকাশ করার পর গোপনে বেশ কয়েকটি স্থানীয় গণমাধ্যমের অফিসে যোগাযোগ করেন খান মামুন। নিজের অপকর্ম ঢাকতে তার পক্ষে সংবাদ প্রকাশ করার জন্য মোটা অঙ্কের অর্থ নিয়ে তার এক প্রতিবেশী আস্থাভাজন ব্যক্তিকে দেখা যায় বিভিন্ন পত্রিকার বারান্দায় ঘুরতে। কিন্তু স্থানীয় পত্রিকায় কর্মরত গণমাধ্যমকর্মীরা তার পক্ষে সংবাদ প্রকাশ করতে অপারগতা প্রকাশ করলে খান মামুনের সেই আস্থাভাজন ব্যাক্তি নামসর্বস্ব একটি অনলাইন নিউজ পোর্টালে তার পক্ষে ছাপাই গাইয়ে মনগড়া সংবাদ প্রকাশ করায়। যেখানে নেই কোনো তথ্যবহুল প্রমাণ। এমনকি সাধারণ জনগনের জন্য দেয়া আওয়ামী সরকারের বিভিন্ন অনুদানের বিষয় নিজের বলে উল্ল্যেখ করা হয়।
Desing & Developed BY EngineerBD.Net
Leave a Reply