শুক্রবার, ১৭ই মে, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ, সকাল ৬:৩৬

শিরোনাম :
কথা দিচ্ছি আপনাদের সেবায় আমি সর্বদা পাশে থাকবো : চেয়ারম্যান প্রার্থী এসএম জাকির হোসেন উপজেলার উন্নয়নে আপনাদের পাশে আমি সর্বদা রয়েছি -ভাইস চেয়ারম্যান প্রার্থী জসিম উদ্দিন মোটরসাইকেল প্রতিকের চেয়ারম্যান প্রার্থীর সমর্থকদের ওপর হামলা, আহত-২ সদর উপজেলায় চেয়ারম্যান প্রার্থী হওয়া কে এই জাকির হোসেন প্রচার-প্রচারণায় ভোটারদের মন জয় করছেন ভাইস চেয়ারম্যান প্রার্থী জসিম যারা আমার জন্য কাজ করেছে আমি তাদের রেখে কখনো পালিয়ে যাইনি-এসএম জাকির হোসেন রেমিটেন্স আহরণে রূপালী ব্যাংকের ২ দিন ব্যাপী ক্যাম্পেইন সম্পন্ন সদর উপজেলা নির্বাচনে ভাইস চেয়ারম্যান প্রার্থী জসিম উদ্দিনের মনোনয়ন বৈধ ঘোষনা বরিশালের দুই উপজেলায় বৈধতা পেলেন ২৫ প্রার্থী ঝালকাঠিতে বেপরোয়া ট্রাক কেড়ে নিল ১৪ প্রাণ
পানির নিচে ৩০ ঘণ্টা বরিশালের সোহাগ : বাড়ীতে চলছিল জানাজার প্রস্তুতি

পানির নিচে ৩০ ঘণ্টা বরিশালের সোহাগ : বাড়ীতে চলছিল জানাজার প্রস্তুতি

dynamic-sidebar

সোহাগ হাওলাদারের সকালটা শুরু হয়েছিল অন্য কোনো দিনের মতোই। এমভি মুসা নূর নামের মালবাহী নৌযানে (বাল্কহেড) ততক্ষণে বালু বোঝাই করা হয়েছে। হাতের কাজ সেরে ইঞ্জিনরুমে ঢুকে পড়েছেন সোহাগ। একফাঁকে মুঠোফোনে কথাও বলেছেন মায়ের সঙ্গে। গত ১০ বছরে এই কক্ষেই বেশি সময় কেটেছে তাঁর। ১১ অক্টোবর সকালে নারায়ণগঞ্জের সোনারগাঁ উপজেলার বৈদ্যের বাজার এলাকা থেকে তাঁদের গন্তব্য ছিল নারায়ণগঞ্জ বন্দর। ১৭ অক্টোবর সোহাগ হাওলাদারের সঙ্গে কথা শুরু হয়েছিল ওই সকালের বর্ণনা দিয়ে। বরিশালের বাবুগঞ্জ উপজেলার কেদারপুর ইউনিয়নের রাহুতকাঠি গ্রামে সোহাগের বাড়ি। যদিও মানুষ এখনো বিশ্বাস করতে পারে না সোহাগ ফিরে এসেছেন। আমরা তাঁর বাড়ির আঙিনায় বসে আবারও কান পাতি সোহাগের কথায়। সেদিনের স্মৃতিচারণা করতে থাকেন সোহাগ—‘চলতে চলতে একসময় মনে হলো জাহাজের সামনের অংশ কোনো কিছুতে আটকে গেছে। তখন আমি জাহাজ পেছন দিকে নেওয়ার (গন ব্যাগার) নির্দেশ পাই। গন ব্যাগার দিয়ে আমি ইঞ্জিনরুম থেকে ওপরে উঠে আসি। এ সময় জাহাজটি একদিকে হেলে পড়ছিল।’ তখন সকাল ১০টা। বন্দর উপজেলার ২ নম্বর ঢাকেশ্বরী সোনাচড়া এলাকায় বিআইডব্লিউটিসির ডকইয়ার্ডের সামনে ছিল এমভি মুসা নূর। ওপর থেকে ইঞ্জিন বন্ধ করার ঘণ্টাধ্বনি পান সোহাগ। সঙ্গে সঙ্গে আবার ইঞ্জিনরুমে গিয়ে ইঞ্জিন বন্ধ করে ওপরে ওঠার চেষ্টা করেন, কিন্তু ততক্ষণে দরজা দিয়ে প্রচণ্ড বেগে পানি ঢুকছে। পানি ঠেলেই বের হওয়ার চেষ্টা করেন সোহাগ, কিন্তু কিছুতেই বের হতে পারলেন না। সাড়ে ১৬ হাজার বর্গফুট বালুভর্তি এমভি মুসা নূর ধীরে ধীরে ডুবে যায় শীতলক্ষ্যার পানিতে। সেদিন নৌযানে কর্মী ছিলেন মোট ছয়জন। সোহাগ হাওলাদার ছাড়া পাঁচজনই সাঁতরে তীরে ওঠেন। এরপর? সোহাগ হাওলাদার অজানায় দৃষ্টি রাখেন। শুধু বলেন, ‘আমার আর কিছুই মনে নেই।’
শুরু হলো উদ্ধারকাজ ॥ সেদিন বিকেলেই শুরু হয় উদ্ধারকাজ। ফায়ার সার্ভিস ও বিআইডব্লিউটিএর ডুবুরি দল নিখোঁজ সোহাগ হাওলাদারকে উদ্ধারের চেষ্টা করেন। দীর্ঘ সময় চেষ্টার পরও উদ্ধার না হওয়ায় স্বজনেরা মরদেহ গ্রহণের প্রস্তুতি নেন। ডুবুরি দিয়ে খুঁজতে থাকেন মরদেহ। আনা হয় কফিন, চা-পাতা, সাদা কাপড়। সন্ধ্যা সাতটা পর্যন্ত চলল উদ্ধার তৎপরতা। কিন্তু খুঁজে পাওয়া গেল না সোহাগের মরদেহ। সমাপ্ত ঘোষণা করা হলো উদ্ধার অভিযান। গ্রামে চলছিল জানাজার প্রস্তুতি ॥ ১২ অক্টোবর। এর মধ্যেই পেরিয়ে গেছে ২৪ ঘণ্টা। সোহাগের মরদেহ উদ্ধারের আশা ছেড়ে দিয়েছিল অনেকে। তবে হাল ছাড়েননি স্বজনেরা। এদিকে গ্রামবাসী প্রস্তুতি নেন গায়েবানা জানাজার। কিন্তু বিকেল চারটায় থেমে গেল সব প্রস্তুতি। শোকের কান্না রূপ নিল আনন্দের অশ্রুতে। কারণ, তখন সোহাগের বাড়িতে পৌঁছে গেছে ডুবুরি জাহাঙ্গীরের কথা—‘বেঁচে আছে।’
ডাক পড়েছিল জাহাঙ্গীরের ॥ ডুবুরি জাহাঙ্গীর আলম সিকদারের ডাক পড়েছিল ১২ অক্টোবর সকালে। মাদারীপুরের শিবচরের এই ডুবুরি ৫০ বছর ধরে এ কাজ করছেন। জাহাঙ্গীর আলম সিকদারের সঙ্গে মুঠোফোনে কথা হয়। তিনি বলেন, ‘আমাকে বলা হয়েছিল ভেতরে একটি মৃতদেহ আছে, বের করতে হবে। চুক্তি হয়, উদ্ধার করতে পারলে ২০ হাজার টাকা দেবেন, না পারলে ৫ হাজার।’ উদ্ধারকাজ করতে এসে জাহাঙ্গীর আলম সিকদার দেখেন বিআইডব্লিউটিএ ও স্থানীয় ডুবুরিরাও আছেন। তাঁদের সঙ্গে কথা বলে পরিস্থিতি বুঝে নেন তিনি। উদ্ধারকাজে সহযোগী হিসেবে নেন বিআইডব্লিউটিএর উদ্ধারকারী জাহাজ ‘প্রত্যয়’-এর ডুবুরি মাসুম মল্লিককে। শুরু হয় তাঁর উদ্ধারকাজ। জাহাঙ্গীর আলম সিকদার বলেন, ‘আমি ইঞ্জিনরুমে গিয়ে দেখি সামনে ও পেছনে দুটি দরজাই আটকানো। প্রথমে গিয়ে পেছনের দরজা ভাঙার চেষ্টা করি। পরে ব্যর্থ হয়ে সামনের দরজা ভাঙি।’ দরজা খোলার পর সেটা বারবার বন্ধ হয়ে যাচ্ছিল। জাহাঙ্গীর আবার ওপরে ওঠেন। বড় দড়ি নিয়ে ফের নামেন পানিতে। দড়ি দিয়ে দরজা একটি হুকের সঙ্গে বাঁধেন জাহাঙ্গীর আলম সিকদার। ঢুকে পড়েন রুমের ভেতরে। জাহাঙ্গীর আলম সিকদার বলেন, ‘সেখানে কোনো পানি ছিল না। শুধু হাওয়া ছিল। আমি ভাবছি, মৃতদেহ হয়তো পানিতে ভেসে থাকবে। ভেতরটা ছিল খুব অন্ধকার। ডিজেলের গন্ধ।’ আধা ঘণ্টা পর খুঁজে পান সোহাগ হাওলাদারকে। খুঁজে পাওয়া সোহাগ যে তখনো জীবিত, বুঝে উঠতে পারেননি জাহাঙ্গীর আলম সিকদার। তিনি বলেন, তাঁর শরীরে হাত দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই তিনি হাত সরিয়ে দেন। আর বলেন, আল্লাহ। অবিশ্বাস্য মনে হয় জাহাঙ্গীর আলমের। অক্সিজেন মাস্ক খুলে ফেলেন তিনি। সোহাগের কাছে জানতে চান, ‘জীবিত আছ?’ উত্তর আসে, ‘হ্যাঁ।’ জাহাঙ্গীর আলম অভয় দিয়ে সোহাগ হাওলাদারকে বলেন, ‘ভয় পেয়ো না, তোমারে উদ্ধারের চেষ্টা করতেছি।’ ওপরে উঠে অন্য ডুবুরির অক্সিজেন মাস্ক নিয়ে আবার চলে যান সোহাগের কাছে। কিন্তু ভয়ে কাঁপছিলেন সোহাগ। মাস্ক পরতে চাইছিলেন না। জাহাঙ্গীর আলম সিকদার বলেন, ‘তাকে বললাম, দেখো, আমি মানুষ। আমার দাড়ি ধরালাম। বুক মেলালাম।’ এভাবেই তাঁর সঙ্গে কথোপকথন চলল ৫০ মিনিট। সংবিৎ খুঁজে পান সোহাগ। রাজি হন মুখোশ পরতে। জাহাঙ্গীর আলম সিকদার বলছিলেন, ‘বেল্ট লাগিয়ে তাকে আস্তে আস্তে ওপরে ওঠালাম। ভেতরে অনেক লোহালক্কড় ছিল। ব্যথা যাতে না পায়, সে জন্য মাথায় এক হাত রেখে ওপরে তুললাম।’ এর মধ্যেই পেরিয়ে গেছে ৩০ ঘণ্টা। কিছুই মনে নেই সোহাগের ॥ উদ্ধার করে ওপরে তুলে আনার পর স্বজনদের দেখে অবাক হন সোহাগ হওলাদার। তাঁর মাথায় প্রশ্ন ঘুরপাক খাচ্ছিল, এত আত্মীয়স্বজন এখানে এসেছে কেন? সোহাগের চাচা মো. আনছার আলী হাওলাদার বলেন, ‘আমরা ঢাকায় থাকি। খবর পেয়েই ছুটে গিয়েছিলাম। ১২ অক্টোবর বিকেল চারটায় সোহাগকে উদ্ধার করার পর বিশ্বাস হচ্ছিল না সে জীবিত।’ বাবুগঞ্জের এক সাধারণ পরিবারের ছেলে সোহাগ হাওলাদার। বাবা বাদল হাওলাদার ও মা পাপিয়া বেগমের বড় ছেলে। ২০০৭ সালে বাবা মারা যান। এরপর সোহাগ পড়াশোনা ছেড়ে পরিবারের দায়িত্ব নেন। কাজ শুরু করেন বালুবাহী জাহাজে ইঞ্জিনচালক হিসেবে। সেদিন উদ্ধারের পরপরই তাঁকে নারায়ণগঞ্জের ৩০০ শয্যাবিশিষ্ট হাসপাতালে চিকিৎসার জন্য নেওয়া হয়। হাসপাতালের বিছানায় শুয়েই মায়ের সঙ্গে ভিডিও কলে কথা বলানোর ব্যবস্থা করা হয়। সোহাগ দেখেন তাঁর মা কাঁদছেন। তিনি কিছুতেই বুঝতে পারেন না মা কাঁদছেন কেন। সোহাগ বলেন, ‘আমার মনে হচ্ছিল একটু আগেই মায়ের সঙ্গে কথা হয়েছে। আমার কাছে সবকিছু স্বাভাবিকই মনে হচ্ছিল। শুধু শরীর, হাত-পা ব্যথা করছিল। জ্বর বোধ হচ্ছিল।’ সেদিন হাসপাতালে স্যালাইন দেওয়ার পর চিকিৎসকেরা সোহাগের অবস্থা শঙ্কামুক্ত বলে জানান আত্মীয়দের। ১৩ অক্টোবর বরিশালে গ্রামের বাড়িতে নেওয়া হয় সোহাগকে। এখন মায়ের কাছেই আছেন তিনি।

আমাদের ফেসবুক পাতা

© All rights reserved © 2018 DailykhoborBarisal24.com

Desing & Developed BY EngineerBD.Net