অফিস বন্ধ থাকায় গত শুক্রবার কর্মস্থল হইতে শ্রীমঙ্গলে নিজ বাড়িতে আসিয়াছিলেন বেসরকারি সংগঠনের কর্মী শুক্লা বীর। একদিনের ব্যবধানে ফিরিবার পথে গত শনিবার সিলেটের জৈন্তাপুরের দরবস্ত এলাকায় মর্মান্তিক সড়ক দুর্ঘটনায় মা ও একমাত্র কন্যাসন্তানসহ প্রাণ হারাইয়াছেন মাত্র ৩১ বত্সর বয়সী এই নারী। জানা যায়, রাস্তার পাশে থাকা বিদ্যুতের খুঁটি বহনকারী একটি ট্রাককে যাত্রীবাহী একটি বাস আঘাত করিলে এই দুর্ঘটনাটি ঘটে। বিনামেঘে বজ্রপাতের মতো অকস্মাত্ স্ত্রী, সন্তান আর শাশুড়িকে হারাইয়া শোকস্তব্ধ শুক্লার স্বামী তপন তরফদার কেবল এইটুকু বলিয়াছেন যে, এক সঙ্গে তিন প্রজন্মকে হারাইয়াছেন তিনি। মামলা করিয়া কী হইবে? তিনি চান, এমন ঘটনা যেন আর না হয়। প্রতিকার দূরে থাক, স্ত্রী ও একমাত্র সন্তানহারানো এই মানুষটির হূদয়মথিত আবেদনেও যে সড়কে মৃত্যুর মিছিল থামিবে না—তাহাতে বিন্দুমাত্র সন্দেহ নাই। দেশের সড়ক-মহাসড়কগুলিতে দুর্ঘটনার মাত্রা এমন পর্যায়ে পৌঁছিয়াছে যে, এখন আর কেহ কোন মায়ের কোল খালি হইয়াছে কিংবা কোন শিশু চিরতরে মাতৃ ও পিতৃস্নেহ হইতে বঞ্চিত হইল তাহা লইয়া মাথা ঘামান না। মৃতরা এখন মানুষ নয়, কতগুলি সংখ্যা মাত্র!
সেই সংখ্যাও আতঙ্কজনক পর্যায়ে পৌঁছিয়াছে ইতোমধ্যে। গত শনিবার প্রকাশিত যাত্রী কল্যাণ সমিতির বার্ষিক প্রতিবেদনে যেই তথ্য উঠিয়া আসিয়াছে তাহা উদ্বেগজনক বলিলে কমই বলা হয়। প্রতিবেদনমতে, ২০১৭ সালে সড়ক দুর্ঘটনার সংখ্যা ও দুর্ঘটনাজনিত মৃত্যুর হার দুই-ই বাড়িয়াছে। সর্বমোট ৪ হাজার ৯শ’ ৭৯টি সড়ক দুর্ঘটনা ঘটে। ইহাতে নিহত হন ৭ হাজার ৩শ’ ৯৭ জন। আহতের সংখ্যা ১৬ হাজারের বেশি। এই হিসাবে এই সময়ে দুর্ঘটনা বাড়িয়াছে সাড়ে ১৫ শতাংশ। আর মৃত্যুর হার বৃদ্ধি পাইয়াছে সাড়ে ২২ শতাংশ। সমিতির নেতৃবৃন্দ জানাইয়াছেন যে, প্রতিবেদনটি প্রণীত হইয়াছে গণমাধ্যমে প্রকাশিত তথ্যের ভিত্তিতে। ফলে সড়ক দুর্ঘটনা এবং দুর্ঘটনাজনিত হতাহতের প্রকৃত সংখ্যা আরো বেশি হওয়াটাই স্বাভাবিক। কারণ সড়ক দুর্ঘটনার সব খবর গণমাধ্যমে আসে না। সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞরা সড়ক দুর্ঘটনাকে ‘অন্যতম মহামারি’ হিসাবে অভিহিত করিয়া ইহার নিরসনকল্পে সমন্বিত পরিকল্পনা এবং মানসম্মত যুগোপযোগী আইনের মাধ্যমে সড়কপথে সার্বিক সুশাসন প্রতিষ্ঠার উপর গুরুত্বারোপ করিয়াছেন। সড়ক পরিবহন দেশের বড় ও গুরুত্বপূর্ণ অর্থনৈতিক খাত হওয়া সত্ত্বেও এই ক্ষেত্রে যে দীর্ঘদিন যাবত্ গুরুতর বিশৃঙ্খলা বিরাজমান তাহা লইয়া খুব একটা দ্বিমত নাই। এমনকি সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষও তাহা স্বীকার করিয়া আসিতেছেন। দুর্ঘটনার কারণ এবং করণীয় বিষয়েও মোটামুটি সকলেই একমত। তাহা সত্ত্বেও কেন সড়কপথে লাগামহীনভাবে জীবন ও সম্পদের অপচয় ঘটিয়া চলিয়াছে তাহা আমাদের বোধগম্য নহে।
সরকারের চতুর্থ বর্ষপূর্তির সাফল্য-ব্যর্থতার হিসাবনিকাশ এখনো চলমান আছে। দেশি-বিদেশি বেশিরভাগ বিশেষজ্ঞই বলিয়াছেন যে, চূড়ান্ত বিচারে সরকারের সাফল্যের পাল্লাই ভারী। চমকপ্রদ সব সাফল্যের মধ্যেও ক্রমবর্ধমান সড়ক দুর্ঘটনার বিষয়টি যে অন্যতম প্রধান অস্বস্তি ও উদ্বেগের কারণ হইয়া আছে তাহা অস্বীকার করিবার উপায় নাই। আমরা কেবল এইটুকু বলিব যে, যে-স্বপ্ন ও রূপকল্পকে সামনে রাখিয়া সরকার আগাইয়া যাইতেছে সড়কপথে শৃঙ্খলা ও সুশাসন প্রতিষ্ঠা করা না গেলে তাহা অধরাই থাকিয়া যাইবে।
Desing & Developed BY EngineerBD.Net
Leave a Reply