আমরা মাদকের সাগরে ভাসিতেছি বলা যায়। সমপ্রতি ইয়াবা লইয়া ইত্তেফাকে নিয়মিতভাবে প্রতিবেদন প্রকাশিত হইয়াছে। সেইখানে উঠিয়া আসিয়াছে ইয়াবা ব্যবসার গডফাদারদের নাম। কোন কোন রুট ধরিয়া এবং কীভাবে নূতন নূতন রুট তৈরি করিয়া ইয়াবা পাচারের জাল বিছানো হইয়াছে দেশজুড়িয়া—তাহারও স্পষ্টচিত্র প্রকাশিত হইয়াছে এইসকল প্রতিবেদনে। গত রবিবার সংসদ ভবনে অনুষ্ঠিত স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির বৈঠকে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর নিকট কমিটির অন্য সদস্যরা প্রশ্ন করিয়াছেন—ইয়াবা গডফাদারদের তালিকা থাকা সত্ত্বেও কেন তাহাদের গ্রেফতার করা হইতেছে না? জবাবে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলিয়াছেন, সুনির্দিষ্ট তথ্য-প্রমাণের ভিত্তিতে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী অবশ্যই ব্যবস্থা লইবে। প্রধানমন্ত্রীও গত বুধবার সংসদে বলিয়াছেন, রাজধানীতে ভবঘুরে শিশু-কিশোরসহ মাদক ব্যবহারকারীদের বিরুদ্ধে আজই (অর্থাত্ বুধবার হইতে) অভিযান চালানো হইবে। প্রধানমন্ত্রী স্পষ্টভাবে বলিয়াছেন, আমরা আমাদের শিশুদের এইভাবে ধ্বংস হইয়া যাইতে দিতে পারি না।
সরকারের শীর্ষপর্যায়ের এমন সদিচ্ছা ও সুনির্দিষ্ট পদক্ষেপের পর মাদক বিস্তারের লাগাম টানা সম্ভবপর হইবে বলিয়া আমরা বিশ্বাস করি। ইহা সত্য যে, বিশ্বের কোনো রাষ্ট্রই মাদকের বিষবায়ু হইতে মুক্ত নহে। বিশ্বের অনেক সচেতন রাষ্ট্র তাহার তরুণ জনগোষ্ঠীকে মাদক হইতে রক্ষা করিতে মিলিয়ন মিলিয়ন ডলার খরচ করিয়া থাকে। ১৯৬০ সালের পর ‘ড্রাগ এবিউজ’ কথাটি প্রচার পায়। মার্কিন সমাজে মাদকাসক্তি বিষয়ে উদ্বেগের উত্থানও তখন হইতেই। আমাদের দেশে মাদকের অনুপ্রবেশ ঘটে আশির দশকে। হেরোইন, কোকেন ও ফেনসিডিল তখন ছড়াইয়া পড়ে তরুণ সমাজে। পরবর্তীকালে অনুপ্রবেশ করিল ইয়াবা। সরকারি মাদকাসক্তি নিরাময় কেন্দ্রের পরিসংখ্যান হইতে জানা যায়, বর্তমানে মাদকাসক্তির চিকিত্সা লইতে আসা রোগীদের মধ্যে ৮০ শতাংশই ইয়াবায় আসক্ত। অনুসন্ধানে দেখা গিয়াছে, গত পাঁচ বত্সরে নেশাখোর ছেলের হাতে ৩৮৭ জন পিতা-মাতা খুন হইয়াছেন। একই সময়ে স্বামীর হাতে খুন হইয়াছে ২৫৬ জন নারী। মাদক সেবন লইয়া বিরোধে বিবাহবিচ্ছেদ ঘটিয়াছে ৫ হাজার ৭৮০টি। একই কারণে প্রেমিক বা প্রেমিকার হাতে খুন হইয়াছে ৬ শতাধিক তরুণ-তরুণী! ভয়াবহ দিক হইল—নানান হাত বদলের মাধ্যমে লক্ষ লক্ষ মানুষের জীবিকা নির্বাহের অন্যতম প্রধান খাত হিসাবে গড়িয়া উঠিয়াছে এই মাদক-ব্যবসা। জানা গিয়াছে, ইয়াবা বড়ির জন্য মাদকসেবীরা বত্সরে প্রায় সাড়ে ছয় হাজার কোটি টাকা খরচ করিয়া থাকেন। কীমাশ্চর্যম! এই বিপুল অঙ্কের অর্থ কিনা বাংলাদেশের সীমান্তরক্ষী বাহিনীর বার্ষিক বাজেটের প্রায় দ্বিগুণ, আর পুলিশের বাজেটের প্রায় অর্ধেক!
দেখা গিয়াছে যে, মাদকসম্রাটদের প্রায় সকলেই ক্ষমতাকেন্দ্রিক রাজনীতির সহিত যুক্ত। বলিবার অপেক্ষা রাখে না, অন্য দল ক্ষমতায় থাকিলে মাদকসম্রাটেরা সেই দলেরই আশ্রয় লইতেন। এমনকী পুলিশের অনুসন্ধানে দেখা গিয়াছে, আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারীদের একটি অংশও এই ব্যবসার সঙ্গে নিবিড়ভাবে জড়িত। সুতরাং সরকারপ্রধান হইতে শুরু করিয়া দেশের সকল আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ইয়াবা প্রতিরোধে ‘জিরো টলারেন্স’ ঘোষণা করিবার পরও মাদকের বিস্তার অপ্রতিরোধ্যই থাকিয়া যায়। আমরা আশা করিব, মাদক প্রতিরোধে সরকারের ‘জিরো টলারেন্স’-এর ফলাফল জিরো হইবে না।
Desing & Developed BY EngineerBD.Net
Leave a Reply